মানব সভ্যতা ক্রান্তিকালে, কিন্তু আশার জায়গা এখনো আছে। -নোম চমস্কি


ভাষাতত্ত্বের জনক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোম চমস্কি মনে করেন — আজকের বিশ্ব এক ভয়াবহ মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মানবতার প্রতি তাঁর আস্থা এখনো অটুট। সম্প্রতি মার্কিন অর্থনীতিবিদ টেইলর কোয়েনের সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে চমস্কি তুলে ধরেছেন আধুনিক সভ্যতার সংকট, মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা, শিক্ষা ব্যবস্থার অবক্ষয়, এবং প্রযুক্তির বিপদ নিয়ে তাঁর গভীর উদ্বেগ ও বিশ্লেষণ।

মনে রাখা প্রয়োজন, যারা রাজনৈতিক ক্যাম্পেইন ডিজাইন করে তারা একইসঙ্গে টুথপেস্ট আর গাড়িও বিক্রি করে।
-নোয়াম চমস্কি


চিন্তার রাজনীতি ও প্রোপাগান্ডা

চমস্কি বলেন, “আজকের গণমাধ্যম আমাদের তথ্য দেয় না, বরং মত তৈরি করে দেয়।” তাঁর মতে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলো এমনভাবে তথ্য পরিবেশন করে যাতে সাধারণ মানুষ প্রকৃত সমস্যার চেয়ে গৌণ বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন তাঁর বিখ্যাত বই Manufacturing Consent–এর বক্তব্য— “গণতন্ত্রে মতামত তৈরি করাই ক্ষমতার প্রকৃত হাতিয়ার”।

চমস্কির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতি এখন একধরনের “নির্বাচিত প্রোপাগান্ডা”–র ফাঁদে আটকে আছে। নাগরিকরা ভাবেন তারা স্বাধীনভাবে মতামত দিচ্ছেন, অথচ অদৃশ্যভাবে তাদের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করছে কর্পোরেট ও রাজনৈতিক শক্তি।

শিক্ষা ও জ্ঞানের অবক্ষয়

কোয়েন যখন জানতে চান, বর্তমান প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতা নিয়ে তাঁর মত কী, চমস্কি বলেন—
“শিক্ষাকে এখন পণ্য হিসেবে দেখা হয়, জ্ঞান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুনাফাকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীরা চিন্তা করার চেয়ে চাকরির যোগ্যতা অর্জনেই ব্যস্ত।”
তাঁর মতে, সত্যিকার শিক্ষা হলো “চিন্তা করার ক্ষমতা গড়ে তোলা” — যা আজকের সমাজে ক্রমশ বিলীন হচ্ছে।

প্রযুক্তি: আশীর্বাদ না অভিশাপ?

চমস্কি প্রযুক্তির উন্নতিকে “দ্বিমুখী তরবারি” বলে বর্ণনা করেন। একদিকে এটি মানুষের জীবন সহজ করেছে, অন্যদিকে নজরদারি, ভুয়া তথ্য, ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) অপব্যবহার সমাজে নতুন ধরণের দাসত্ব সৃষ্টি করছে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, “যখন প্রযুক্তি মানবিক মূল্যবোধকে প্রতিস্থাপন করে, তখন মানুষ নিজেই তার তৈরি যন্ত্রের দাসে পরিণত হয়।”

মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ

চমস্কি বর্তমান জলবায়ু সংকট ও যুদ্ধবাজ রাজনীতির উদাহরণ টেনে বলেন— “আমরা এমন এক সময়ের দিকে এগোচ্ছি, যেখানে মানবজাতি নিজেকেই ধ্বংস করতে পারে।”
তবুও তাঁর কণ্ঠে আশার সুর —
“ইতিহাস বলে, মানুষ যখন বিপদের মুখে পড়ে, তখনই সে সৃজনশীলভাবে জেগে ওঠে। আমাদের প্রজন্ম যদি মানবতা ও যুক্তিবোধ ধরে রাখতে পারে, তবে পৃথিবী বাঁচবে।”

চমস্কি কে আজও শুনছে?

৯৬ বছর বয়সেও চমস্কির চিন্তা বিশ্বজুড়ে তরুণ প্রজন্মকে নাড়া দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম কিংবা বিকল্প সংবাদ প্ল্যাটফর্ম— সর্বত্র তাঁর উক্তি আলোচনায়।
তাঁর কথায়, “মানুষের স্বাধীন চিন্তার মৃত্যু ঘটলে, সভ্যতা কেবল প্রযুক্তিগত আবরণ হয়ে বেঁচে থাকবে।”

শেষ কথা

চমস্কি হয়তো আজীবন বিতর্কিত থেকেছেন, কিন্তু তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক সততা ও মানবিক বিশ্বাস এখনও বিশ্ববিবেককে আলো দেয়। টেইলর কোয়েনের সঙ্গে এই সাক্ষাৎকার আবারও প্রমাণ করেছে— বয়স বা সময় নয়, চিন্তার গভীরতাই একজন মানুষকে ইতিহাসে অমর করে তোলে।

admin

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *